ধান চাষ পদ্ধতি, ধানের বিভিন্ন রোগের লক্ষণ ও দমন পদ্ধতি

জমি নির্বাচন : বাংলাদেশে দানাজাতীয় ফসলের মধ্যে ধানের চাষ ও উৎপাদন সবচেয়ে বেশি । কারণ মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য হলাে ভাত । ধানের ফলন সব জমিতে ভালাে হয় না । মাঝারি নিচু ও নিচু জমিতে ধানের ফলন বেশি ভালাে হয় । মাঝারি উঁচু জমিতে ধান চাষ করা হয় । কিন্তু সেক্ষেত্রে পানি সেচের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয় । এঁটেল ও পলি দোআঁশ মাটি ধান চাষের জন্য উপযােগী ।

ধানের জাতসমূহ : বাংলাদেশে তিন জাতের ধান আছে । যথা :

ক ) স্থানীয় জাত : টেপি , গিরবি , দুধসর , লতিশাইল ।

খ ) স্থানীয় উন্নতজাত : কটকতারা , কালিজিরা , হাসিকলমি , নাইজারশাইল , লতিশাইল , বিনাশাইল ইত্যাদি ।

গ ) উচ্চফলনশীল ( উফশী ) জাত : বাংলাদেশে অনেক জমিতে উফশী ( উচ্চ ফলনশীল ) ধানের চাষ করা হয়ে থাকে । উফশী ধানের জাতগুলাের সাধারণ কতগুলাে বৈশিষ্ট্য থাকে । যেমন :

• গাছ মজবুত এবং পাতা খাড়া ।
• শীষের ধান পেকে গেলেও গাছ সবুজ থাকে ।
• গাছ খাটো ও হেলে পড়ে না ।
• খড়ের চেয়ে ধানের উৎপাদন বেশি ।
• পােকা ও রােগের আক্রমণ কম হয় ।
• অধিক কুশি গজায় ।
• সার গ্রহণক্ষমতা অধিক এবং ফলন বেশি ।

উফশী ধানে যখন প্রয়ােজনীয় বিশেষ গুণাগুণ , যেমন - রােগবালাই সহনশীলতা , স্বল্প জীবনকাল , চিকন চাল , খরা , লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু ইত্যাদি সংযােজিত হয় , তখন তাকে আধুনিক ধান বলে । তাই সকল উফশী ধান আধুনিক নয় , কিন্তু সকল আধুনিক ধানে উফশী গুণ বিদ্যমান ।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ( ব্রি ) বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে এ পর্যন্ত ধানের উফশী ৭৮টি জাত ও উদ্ভাবন করেছে । ধানের মৌসুম তিনটি । যথা -
আউশ ,
আমন ও
বােরাে ।

ব্রি ধানের কতকগুলাে অনুমােদিত জাত আছে যেগুলাে আউশ ও বােরাে দুই মৌসুমেই চাষ করা যায় । যেমন - বিআর ১ ( চান্দিনা ) , বি আর ২ ( মালা ) , বিআর ৯ ( সুফলা ) , বিআর ১৪ ( গাজী ) । আবার বিআর ৩ ( বিপ্লব ) জাত সকল মৌসুমে চাষ করা যায় ।

নিচে তিন মৌসুমের অনুমােদিত জাতগুলাের সংখ্যা ও কিছু জাতের নাম উল্লেখ করা হলাে :

ক ) আউশ মৌসুমের জাত : শুধু আউশ মৌসুমেই চাষ করা হয় এরূপ জাত হলাে ৮টি । এদের মধ্যে কয়টি বিআর ২০ ( নিজামী ) , বিআর ২১ ( নিয়ামত ) ইত্যাদি । এ জাতগুলাে আউশ মৌসুমে বপন ও রােপণ দুইভাবেই আবাদ করা যায় । এ মৌসুমে বীজ বপনের উপযুক্ত সময় ১৫ - ৩০ শে চৈত্র এবং চারা রােপণের জন্য চারার বয়স হবে ২০ - ২৫ দিন ।

খ ) আমন মৌসুমের জাত : শুধু আমন মৌসুমেই চাষ করা হয় এরূপ জাত হলাে ২৭টি । এদের কয়েকটি হলাে বিআর ৫ ( দুলাভােগ ) , বিআর ১১ ( মুক্তা ) , বিআর ২২ ( কিরণ ) , ব্রি ধান ৫৬ , ব্রি ধান ৫৭ ও ব্রি ধান ৬২ ইত্যাদি । সবগুলাে জাতই রােপণ পদ্ধতিতে চাষ করা হয় এবং রােপণের জন্য চারার বয়স হতে হবে ২৫ - ৩০ দিন ।

গ ) বােরা মৌসুমের জাত : শুধু বােরাে মৌসুমেই চাষ করা যায় এরূপ জাত হলাে ১৬টি । এদের কয়েকটি হলাে বিআর ১৮ ( শাহজালাল ) , ব্রি ধান ২৮ , ব্রি ধান ২৯ , ব্রি ধান ৪৫ , ব্রি ধান ৫০ ( বাংলামতি ) , ব্রি হাইব্রিড ধান ১ , ব্রি হাইব্রিড ধান ২ এবং ব্রি হাইব্রিড ধান ৩ ইত্যাদি । রোপণের জন্য চারার বয়স হতে হবে ৩৫ - ৪৫ দিন ।

এ ছাড়া ধান ফসলের আরও কিছু জাত আছে । যেমন : বৃষ্টিবহুল , খরা - সহিষ্ণু , লবণাক্ততা - সহিষ্ণু , হাওর , ঠাণ্ডা - সহিষ্ণু জাত ইত্যাদি ।

বীজ বাছাই : কমপক্ষে শতকরা ৮০ ভাগ বীজ গজায় এরূপ পরিষ্কার , সুস্থ ও পুষ্ট বীজ বীজতলায় বপনের জন্য বাছাই করতে হবে । নিম্নবর্ণিত পদ্ধতিতে বীজ বাছাই করা হয় ।

প্রথমে দশ লিটার পরিষ্কার পানিতে ৩৭৫ গ্রাম ইউরিয়া সার মিশিয়ে প্রাপ্ত দ্রবণে ১০ কেজি বীজ ছেড়ে হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে দিলে পুষ্ট বীজ ডুবে নিচে জমা হবে এবং অপুষ্ট ও হালকা বীজগুলাে পানির উপর ভেসে উঠবে । হাত বা চালনি দিয়ে ভাসমান বীজগুলাে সরিয়ে নিলেই পানির নিচ থেকে ভালাে বীজ পাওয়া যাবে । এ বীজগুলাে পুনরায় পরিষ্কার পানিতে ৩ - ৪ বার ধুয়ে নিতে হবে । এক্ষেত্রে ইউরিয়া মেশানাে পানি বীজতলায় সার হিসাবে ব্যবহার করা যায় ।

বীজ শােধন ও জাগ দেওয়া : বাছাইকৃত বীজ দাগমুক্ত ও পুষ্ট হলে সাধারণভাবে শােধন না করলেও চলে । তবে শোধনের জন্য ৫২ - ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ( হাতে সহনীয় ) তাপমাত্রার গরম পানিতে ১৫ মিনিট বীজ ডুবিয়ে রাখলে জীবাণুমুক্ত হয় । এছাড়া প্রতি কেজি ধান বীজ ৩০ গ্রাম কার্বক্সিন ( ১৭ . ৫ % ) + থিরাম ( ১৭ . ৫ % ) দ্বারাও শোধন করা যায় । শােধনকৃত বীজ বাঁশের টুকরি বা ড্রামে ২ - ৩ স্তর শুকনাে খড় বিছিয়ে তার উপর বীজের ব্যাগ রেখে পুনরায় ২ - ৩ স্তর শুকনাে খড় দিয়ে বা কচুপাতা দিয়ে ঢেকে ভালােভাবে চেপে তার উপর কোনাে ভারী জিনিস দিয়ে চাপ দিয়ে রাখতে হবে । এভাবে জাগ দিলে আউশ ও আমন মৌসুমের জন্য ৪৮ ঘণ্টা বা দুই দিনে , বােরাে মৌসুমে ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিনে ভালাে বীজের অঙ্কুর বের হবে এবং সেগুলাে বীজতলায় বপনের উপযুক্ত হবে ।

বীজতলা তৈরি : ধানের চারা তৈরির জন্য সাধারণত চার ধরনের বীজতলা তৈরি করা হয় । যথা

ক ) শুকনাে বীজতলা ।
খ ) ভেজা বীজতলা ।
গ ) ভাসমান বীজতলা ।
ঘ ) দাপােগ বীজতলা ।

উঁচু ও দোআঁশ মাটিসম্পন্ন জমিতে শুকনাে বীজতলা এবং নিচু ও এঁটেল মাটি সম্পন্ন জমিতে ভেজা বীজতলা তৈরি করা হয় । আর বন্যাকবলিত এলাকায় ভাসমান ও দাপােগ বীজতলা তৈরি করা হয় । প্রচুর আলাে বাতাস থাকে এবং বৃষ্টি বা বন্যার পানিতে ডুবে যাবে না এমন জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হয় । এখানে শুকনাে ও ভেজা বীজতলা সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে :

ক ) শুকনাে বীজতলা : বীজতলার জমি উর্বর হওয়া প্রয়ােজন । জমিতে ৪ / ৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ভালােভাবে ঝুরঝুরা ও সমান করতে হবে । মাটিতে অবশ্যই রস থাকতে হবে । প্রয়ােজনে সেচ দিতে হবে । এর আগে জমি থেকে আগাছা বেছে সরিয়ে ফেলতে হবে । জমি যদি অনুর্বর হয় জমিতে জৈব সার দিতে হবে । বীজতলায় রাসায়নিক সার ব্যবহার না করাই উত্তম ।

বীজতলার মাপ : এক শতক জমিতে দুই খণ্ডের বীজতলা তৈরি করা যায় । প্রতিটি বীজতলার আকার ১০মিটার x ৪ মিটার জায়গার মধ্যে নালা বাদ দিয়ে ৯ . ৫ মিটার x ১ . ৫ মিটার হবে । বীজ তলার চারদিকে ২৫ সেমি জায়গা বাদ দিতে হবে এবং দুই খণ্ডের মাঝখানে ৫০ সেমি জায়গা নালার জন্য রাখতে হবে । বীজতলায় বীজ বােনার আগে বীজ জাগ দিতে হবে । বিভিন্ন জাতের ধানের অঙ্কুর বের হওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়কাল দরকার । যেমন - আউশের জন্য ২৪ ঘণ্টা , আমিনের জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগে । এক শতক বীজতলার জন্য ৩ কেজি পরিমাণ বীজ উল্লিখিত নিয়মে জাগ দিয়ে অঙ্কুরিত করতে হবে । এরুপ অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় বুনতে হবে ।

চারার পরিচর্যা ও অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য দুই বেডের মাঝের জায়গা থেকে মাটি উঠিয়ে দুই বেডে সমানভাবে উঠিয়ে দিতে হবে । এতে বেডগুলাে উঁচু হয় । এরপর প্রতি বর্গমিটার বেডে ৬০ - ৮০ গ্রাম বীজ বেডের উপর সমানভাবে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে । বেডের উপরের মাটি বাঁশ বা কাঠের চ্যাপ্টা লাঠি দিয়ে সমান করতে হবে । দুই বেডের মাঝে সৃষ্ট নালা সেচ , নিষ্কাশন ও সার বা ঔষধ প্রয়ােগের জন্য খুবই দরকার হয় ।

খ ) ভেজা বীজতলা : এক্ষেত্রে জমিতে পানি দিয়ে ২ - ৩টি চাষ ও মই দেওয়ার পর ৬ - ৭ দিন ফেলে রাখতে হয় । এতে জমির আগাছা , খড়কুটা ইত্যাদি পচে গিয়ে সারে পরিণত হয় । এরপর জমি আরও ২ - ৩ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি থকথকে কাদাময় করতে হয় । ভেজা বীজতলায় বীজ বাড়িতে গজিয়ে বােনা ভালাে । এক্ষেত্রেও বীজতলার মাপ শুকনাে বীজতলার মতােই ।

বীজতলার পরিচর্যা : পাখি যাতে বীজতলার বীজ খেতে না পারে সেজন্য বপনের সময় থেকে ৪ - ৫ দিন পর্যন্ত পাহারা দিয়ে পাখি তাড়ানাের ব্যবস্থা করতে হবে । বেড যাতে শুকিয়ে না যায় সেজন্য দুই বেডের মাঝের নালায় পানি রাখার ব্যবস্থা করতে হয় । এরপর নালা থেকে প্রয়ােজনীয় পানি বেডে সেচ দিতে হয় । বীজ তলায় আগাছা জন্মালে তা তুলে ফেলতে হয় ।

রােগ বা পােকামাকড়ের আক্রমণ দেখা দিলে তা কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে । বীজ তলার চারাগুলাে হলদে হয়ে গেলে প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার প্রয়ােগ করতে হবে । ইউরিয়া প্রয়ােগের পর চারাগুলাে সবুজ না হলে গন্ধকের ( সালফার ) অভাব হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে । এ ক্ষেত্রে বীজতলায় প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম করে জিপসাম সার উপরি প্রয়ােগ করতে হবে । অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় বীজতলায় চারাগুলাে ক্ষতি হতে পারে । তাই রাতে পলিথিন দ্বারা চারাগুলাে ঢেকে দিনের বেলায় খােলা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে । এতে চারার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে ।

চারা উঠানাে :

১ । চারা তােলার পূর্বে বীজতলায় পানি সেচ দিয়ে মাটি ভিজিয়ে নেওয়া উত্তম । এতে বীজতলার মাটি নরম হয় । ফলে চারা তুলতে সুবিধা হয় ।

২ । ধানের চারা পােকায় আক্রান্ত থাকলে কীটনাশক প্রয়ােগ করতে হবে ।

৩ । চারার গােড়া বা কাণ্ড যাতে না ভাঙে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে ।

৪ । চারা তােলার পর তা ছােট ছােট আঁটি আকারে বেঁধে নিতে হয় ।

চারা বহন ও সংরক্ষণ : সরাসরি রােপণের ক্ষেত্রে

১ । বীজতলা থেকে রােপণের জন্য চারা বহন করার সময় পাতা ও কাণ্ড মােড়ানাে যাবে না ।

২ । ঝুড়ি বা টুকরিতে সারি করে সাজিয়ে পরিবহন করতে হয় ।

৩ । বস্তাবন্দী করে কখনাে ধানের চারা বহন করা যাবে না ।

৪ । চারা সরাসরি রােপণ সম্ভব না হলে চারার আঁটি ছায়ার মধ্যে ছিপছিপে পানিতে রেখে সংরক্ষণ করতে হবে ।

জমি তৈরি : ৪ - ৫ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে জমি ভালােভাবে কাদাময় ও সমান করে নিতে হবে । এক্ষেত্রে কোদাল দিয়ে জমির চারদিক ছেটে দিতে হবে ।

সার ব্যবস্থাপনা : ভালাে ফলন পেতে হলে অবশ্যই জমিতে সার দিতে হবে । এছাড়া উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত মাটি থেকে বেশি পরিমাণে খাদ্যোপাদান গ্রহণ করে বিধায় সার প্রয়ােগ অত্যাবশ্যক । গােবর বা আবর্জনা পচা জাতীয় জৈব সার জমি তৈরির সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে । ইউরিয়া ব্যতীত সকল রাসায়নিক সার যেমন - টিএসপি , এমওপি , জিপসাম , দস্তা প্রভৃতি জমিতে শেষ চাষ দেওয়ার আগে প্রয়ােগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে ।

চারা রােপণ করার পর ইউরিয়া সার ৩ কিস্তিতে ছিটিয়ে প্রয়ােগ করতে হয় । ১ম কিস্তি চারা রােপণের ১৫ - ২০ দিন পর , ২য় কিস্তি ৩০ - ৩৫ দিন পর অর্থাৎ চারার গােছায় ৪ - ৫টি কুশি আসা অবস্থায় এবং শেষ কিস্তি ৪৫ - ৫০ দিন পর অর্থাৎ কাইচ থােড় আসার ৫ - ৭ দিন আগে প্রয়ােগ করতে হবে ।

নিচে শতক প্রতি জৈব সার , ইউরিয়া , টিএসপি , এমওপি , জিপসাম ও দস্তা সারের পরিমাণ দেওয়া হলাে :

সারের নাম -- পরিমাণ:

• পচা গোবর বা কমপােষ্ট -- ২০ কেজি
• ইউরিয়া -- ৩৬০ - ৮৪০ গ্রাম ।
• টিএসপি -- ৩০০ - ৫০০ গ্রাম ।
• এমওপি -- ১৬০ - ২৮০ গ্রাম ।
• জিপসাম -- ২৪০ - ২৮০ গ্রাম ।
• দস্তা -- ৪০ গ্রাম ।


শতকপ্রতি ২০ কেজি পচা গােবর সার কমপােস্ট দিলে ভালাে ফলন পাওয়া যায় ।

সার প্রয়ােগের সাধারণ নীতিমালা : জাত ও মৌসুম ছাড়া সার প্রয়ােগের ক্ষেত্রে আরও কিছু নীতিমালা মেনে চলতে হয় । যেমনঃ

১ । পাহাড়ের পাদভূমির মাটি ও লাল বেলে মাটিতে এমওপি সার দেড়গুণ দিতে হয় ।

২ । গঙ্গাবাহিত পলিমাটি ও সেচপ্রকল্প এলাকার মাটিতে দস্তা সার বেশি পরিমাণে দিতে হয় ।

৩ । হাওর এলাকার মাটিতে প্রত্যেক সার কম পরিমাণে দিতে হবে ।

৪ । স্থানীয় জাতের ধানে সারের পরিমাণ অর্ধেক প্রয়ােগ করতে হবে ।

চারা রোপণ : সমান করা সমতল জমিতে জাত ও মৌসুম ভেদে ২৫-৪৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করা ভালো । জমিতে ছিপছিপে পানি রেখে দড়ির সাহায্যে সারি করে চারা রোপন করতে হবে । এক সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব ২৫ সেমি এবং সারিতে এক গোছা থেকে অন্য গোছার দূরত্ব ১৫-২০ সেমি হওয়া দরকার । প্রতি গোছায় দুই থেকে তিনটি চারা রোপণ করতে হবে । দেরিতে রোপণ করলে চারার সংখ্যা বেশি ও ঘন করে রোপণ করতে হবে ।

পরিচর্যা :

ক) সেচ : জমি সমান হলে মুক্ত প্লাবন পদ্ধতিতে ও  ঢালু হলে আইল বেধে মুক্ত প্লাবন পদ্ধতিতে পানি সেচ দিতে হয় । বোরো ধান সম্পূর্ণভাবে সেচের ওপর নির্ভরশীল । জমিতে ৫-৭ সেমি এর নিচে পানি থাকলে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয় । চারা রোপণ করার পর ৬-৭ সেমি এর নিচে পানি থাকলে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে । চারা রোপণ করার ৬-৭ দিন পর্যন্ত ৩-৫ সেমি সেচ দিতে হয় । এতে আগাছা দমন হয় । এরপর কুশি উৎপাদন পর্যায়ে ২-৩ সেমি এবং চারার বয়স ৫০-৬০ দিন হলে ৭-১০ সেমি পরিমাণ পানি সেচ দেয়া উত্তম । থোড় আসার সময় পানি সেচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । দানা পুষ্ট হওয়া শুরু করলে আর সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয়না ।

খ) আগাছা দমন : কমপক্ষে তিনবার ধানের জমিতে আগাছা পরিষ্কার করতে হয় । যেমন :

১) চারা রোপণ করার ১০-১৫ দিনের মধ্যে ।
২) প্রথম আগাছা দমনের পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে ।
৩) থোড় বের হওয়ার পূর্বে ।

ধান ক্ষেতে সাধারণত আড়াইল,পইচা,শ্যামা প্রভৃতি আগাছার উপদ্রব হয় । এগুলো সরাসরি হাত নিড়ানি ও ঔষধ প্রয়োগ করে দমন করা যায় ।

গ) পোকা দমন : ধানক্ষেতে অনেক পোকার উপদ্রব হয় । এদের আক্রমণে ধানের ফলন অনেক কমে যায় । সাধারণত ধান ফসলে মাজরা পোকা, পামরি পোকা, বাদামি গাছ ফড়িং,গান্ধি পোকা, পল মাছি, শীবকাটা লেদা পোকা প্রভৃতি দেখা যায় ।

নিচে কয়েকটি পোকার পরিচিত ও দমন পদ্ধতি আলোচনা করা হলো :
নিম্নলিখিত তালিকায় পােকার আক্রমণের লক্ষণসমূহ অনুযায়ী কীটনাশক ব্যবহার করে পােকা দমন করা যায় ।

তালিকা ১ :
পােকার নাম -- আক্রমনের লক্ষণসমূহ

১ . মাজরা পােকা : ১) ধান গাছের মাঝডগা ও শীষের ক্ষতি করে , ২ ) কুশি অবস্থায় আক্রমণ করলে মাঝ ডগা সাদা হয়ে যায় , ৩ ) ফুল আসার পর আক্রমণ করলে ধানের শীষে সাদা চিটা হয় , ৪ ) সব ঋতুতেই কমবেশি আক্রমণ করে ।

২ . পামরি পােকা : ১ ) পামরি পােকার কীড়া পাতার ভিতরে ছিদ্র করে সবুজ অংশ খায় । ২ ) পূর্ণ বয়স্ক পােকা পাতার সবুজ অংশ খুঁড়ে খুঁড়ে খায় বলে পাতা সাদা হয়ে যায় ।

৩ . গলমাছি : ১ ) গল মাছির কীড়া ধানগাছের বাড়ন্ত কুশিতে আক্রমণ করে এবং আক্রান্ত কুশি পিঁয়াজ পাতার মতাে হয়ে যায় । ২ ) কুশিতে শীষ হয় না ।

৪ . গান্ধি পােকা : ১ ) গান্ধি পােকা ধানের দানায় দুধ সৃষ্টির সময় আক্রমণ করে । ২ ) বয়স্ক পােকার গা থেকে গন্ধ বের হয় ।

৫ , বাদামি গাছ ফড়িং : ১ ) ধানের গােড়ায় বসে রস চুষে খায় , ২ ) গাছ পুড়ে যাওয়ার রং ধারণ করে মরে যায় , একে হপার বার্ন বলে ।

তালিকা ২ :

পােকার নাম ••• কীটনাশকের নাম :

• গান্ধি পােকা , পামরি পােকা , মাজরা পােকা , গলমাছি , ছাতরা পােকা , চুঙ্গী পােকা , পাতা মােড়ানাে পােকা , পাতা শােষক পােকা ••• ক্লোরােপাইরিফস ৫০ বা ম্যালাথিয়ন ৫৭ বা ফেনিট্রথিয়ন ৫৭ বা ডায়াজিনন ৬০ ।

বাদামি গাছ ফড়িং ••• কার্বোফুরান ৩ জি ১০জি বা ডায়াজিনন ১৪ ।

শীষকাটা লেদা পােকা ••• ভেপােনা ১০০ ।

রােগ দমনঃ

ধান গাছের অনেক রােগ হয় । ছত্রাক , ভাইরাস , ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি জীবাণু রােগের কারণ । ও নিচে কয়েকটি ক্ষতিকর রােগের কারণ , লক্ষণ ও দমন পদ্ধতি বর্ণনা করা হলাে :
( রােগের নাম -কারণ-লক্ষণসমূহ-দমনপদ্ধতি )

১ ▪ ব্লাস্ট রােগ - ছত্রাকের কারণে হয় ।

লক্ষণ : 
• পাতায় ডিম্বাকৃতির দাগ পড়ে ।
• দাগের চারদিকে গাড় বাদামি ও মাঝের অংশ সাদা ছাই বর্ণের হয় ।
• অনেকগুলাে দাগ একত্রে মিশে গিয়ে সম্পূর্ণ পাতা মরে যায় ।

দমন পদ্ধতি :

• নীরােগ বীজ ব্যবহার করা ।
• পটাশ জাতীয় সার উপরি প্রয়ােগ করা ।
• বীজ শােধন করে বােনা ।
• জমিতে পানি ধরে রাখা ।
• জমিতে জৈব সার প্রয়ােগ করা ।
• রােগ প্রতিরােধ জাত বিআর৩ , বিআর ১৪ , বিআর ১৫ , বিআর ১৬ , বিআর ২৪ , ব্রি ধান ২৮ রােপণ করা ।

২ ▪ টুংরো রোগ - ভাইরাসের কারণে হয় ।

লক্ষণ : 

• চারা রােপণের এক মাসের মধ্যে টুংরো রোগ দেখা দিতে পারে ।
• আক্রমনের প্রথম পাতার রঙ হালকা সবুজ , পরে আস্তে আস্তে হলুদ হয়ে যায় ।
• গাছ টান দিলে সহজেই ওঠে আসে ।
• কুশি হয় না ।
• প্রথমে দু-একটি গোছায় এ রোগটি দেখা যায় পরে ধীরে ধীরে আশেপাশের গোছায় ছড়িয়ে পড়ে ।

দমন পদ্ধতি :

• পাতা ফড়িং এ রােগ ছাড়ায় , তাই পাতা ফড়িং দমন করতে হবে ।
• রােগ প্রতিরােধীজাত যেমন - চান্দিনা , দুলাভােগ , ব্রি শাইল , গাজী , বিআর ১৬ ,  বিআর ২২ , ব্রি ধান ৩৭ , ব্রি ধান ৩৯ , ব্রি ধান ৪১ , ব্রি ধান ৪২ চাষ করা ।
• আলোর ফাঁদ ব্যবহার করে সবুজ পাতা ফড়িং মেরে ফেলা ।
• রােগাক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলে ।
• ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি স্প্রে করা ।


এছাড়া ধান ফসলে পাতা পােড়া রােগ , উফরা রােগ , খােল পােড়া রােগ , বাকানি রােগ , বাদামি দাগ রােগ , খােলপচা রােগ , স্মাট প্রভৃতি রােগ দেখা যায় ।

ফসল কর্তন , মাড়াই ও সংরক্ষণ :

শীষে ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে । অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে , শীষ ভেঙে যায় , শীষকাটা লেদা পােকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পারে । শীষের উপরের দিকে শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ এবং নিচের অংশের ২০ ভাগ ধানের চাল আংশিক শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতাে পেকেছে বলে বিবেচিত হবে । কাটার পর ধান মাঠে ফেলে না রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাড়াই করা দরকার । কাঁচা খলার উপর ধান মাড়াই করার সময় চাটাই , চট বা পলিথিন বিছিয়ে দিতে হবে । এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রং উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে । মাড়াইয়ের পর ধান ৩ - ৪ দিন পূর্ণ রােদে শুকাতে হবে । এবার ভালােভাবে কুলাদিয়ে ঝেড়ে সংরক্ষণ করতে হবে । যে পাত্রে ধান রাখা হবে তা পরিপূর্ণ করে রাখতে হবে । সংরক্ষণের সময় নিম / নিশিন্দা / বিষকাটালীর পাতা ( গুড়া ) মিশিয়ে দিলে পােকার আক্রমণ হয় না । তারপর পাত্রের মুখ শক্ত করে বন্ধ করতে হবে যেন ভিতরে বাতাস না ঢুকে ।

ফলন :

আউশের চেয়ে আমনের , আবার আমনের চেয়ে বােরাের ফলন বেশি হয়ে থাকে । উল্লেখ্য স্থানীয় জাতের তুলনায় উফশী জাতের ফলন বেশি হয়ে থাকে । উফশী জাতের ধানের হেক্টরপ্রতি ফলন ৫ - ৬ টন এবং শতক ( ৪০ বর্গমিটার ) প্রতি ২০ - ২৪ কেজি ।

Post a Comment

0 Comments