মাশরুম চাষ পদ্ধতি ও মাশরুম চাষের প্রয়ােজনীয়তা

মাশরুম চাষ পদ্ধতি :

বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে চাষ করা যায় মিল্কি , ঋষি ও স্ট্র মাশরুম এবং শীতকালে শীতাকে , বাটন , শিমাজি ও ইনােকি মাশরুম । বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি চাষ করা হয় বারােমাসি ওয়েস্টার মাশরুম । বিভিন্ন ধরনের মাশরুম চাষে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে । আমরা এ পাঠে ওয়েস্টার মাশরুম চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানব ।



মাশরুমের বীজ বা স্পন তৈরি : মাশরুমের বীজ ল্যাবরেটরিতে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদন করা হয় । চাষি পর্যায়ে মাশরুম চাষের জন্য প্যাকেটজাত বীজ কিনতে পাওয়া যায় যাকে বাণিজ্যিক স্পন বলে । আবার খড় দিয়ে চাষিরা নিজেরাও স্পন তৈরি করে নিতে পারেন । সে ক্ষেত্রে চাষিদেরকে বাজার থেকে মাদার স্পন সংগ্রহ করে স্পন তৈরি করে নিতে হয় ।

চাষঘর তৈরি : মাশরুম চাষের ঘরটিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন প্রবেশের জন্য জানালা রাখতে হবে । ঘরটিতে আবছা আলাের ব্যবস্থা রাখতে হবে । ঘরের তাপমাত্রা ২০ - ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখার ব্যবস্থা করতে হবে । মাশরুম আদ্র অবস্থা পছন্দ করে । ঘরটিতে ৭০ - ৮০ % আপেক্ষিক আর্দ্রতার ব্যবস্থা করতে হবে । মাশরুম চাষ ঘরে অসংখ্য অনুজীবের শ্বাস - প্রশ্বাসের ফলে প্রচুর কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয় । কার্বন ডাই অক্সাইড ভারী বলে নিচের দিকে জমা হয় । এজন্য বেড়ার নিচে খােলা রাখতে হয় ।

স্পন সংগ্রহ : চাষঘর তৈরির পর বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে পলি প্যাকেটে তৈরি স্পন সংগ্রহ করতে হবে । ভালাে স্পনের বৈশিষ্ট্য হলাে প্যাকেটটি সুষমভাবে মাইসিলিয়াম দ্বারা পূর্ণ ও সাদা হবে । স্পন সংগ্রহের পর তাড়াতাড়ি প্যাকেট কাটার ব্যবস্থা করতে হবে । কাটতে দেরি হলে বস্তা থেকে প্যাকেট বের করে আলাদা আলাদা জায়গায় ঘরের ঠাণ্ডা স্থানে রাখতে হবে ।

প্যাকেট কর্তন : চাষঘরে বসানাের আগে স্পন প্যাকেট সঠিক নিয়মে কেটে চেঁছে পানিতে চুবিয়ে নেওয়া প্রয়ােজন । স্পন প্যাকেটের কোনাযুক্ত দুই কাঁধ বরাবর প্রতি কাধে ২ ইঞ্চি লম্বা এবং ১ ইঞ্চি ব্যাস করে কাটতে হবে । উভয় পার্শ্বের এ কাটা জায়গার সাদা অংশ ব্লেড দিয়ে চেঁছে ফেলতে হবে । এবার প্যাকেটটি ৫ - ১৫ মিনিট পানিতে উপুড় করে চুবিয়ে নিতে হবে । চুবানাের পর পানি ভালােভাবে ঝরিয়ে সরাসরি চাষঘরের মেঝেতে অথবা তাকে সারি করে সাজিয়ে চাষ করতে হবে ।

পরিচর্যা : চাষঘরের মেঝে বা তাকে দুই ইঞ্চি পর পর স্পন সাজাতে হবে । স্পন প্যাকেটের চারপাশের আর্দ্রতা ৭০ - ৮০ % রাখার জন্য প্রয়ােজন অনুযায়ী গরমে ৪ - ৫ বার , শীতে বা বর্ষায় ২ - ৩ বার পানি   স্প্রে করতে হবে । স্প্ৰেয়ারের নজল প্যাকেটের এক ফুট উপরে রেখে স্প্রে করতে হবে । আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্পন প্যাকেটের উপর কখনাে খবরের কাগজ ভিজিয়ে , কখনাে বস্তা ভিজিয়ে একটু উঁচু করে রাখতে হবে ।

অন্যান্য পরিচর্যা : পরিচর্যা ঠিকমতাে হলে ২ - ৩ দিনের মধ্যে মাশরুমের অঙ্কুর পিনের মতাে বের হবে । প্রতি পার্শ্বে ৮ - ১২টি বড় অঙ্কুর রেখে ছােটগুলো কেটে ফেলতে হবে । ৫ - ৭ দিনের মধ্যে মাশরুম তােলার উপযােগী হবে । প্রথমবার মাশরুম তােলার পর একদিন বিশ্রাম অবস্থায় রাখতে হবে । পরের দিন আগের কাটা অংশে পুনরায় ব্লেড দিয়ে চেঁছে ফেলে পানি স্প্রে করতে হবে । একটি প্যাকেট থেকে ৮ - ১০ বার মাশরুম সংগ্রহ করা যায় । এতে একটি প্যাকেট থেকে ২০০ - ২৫০ গ্রাম মাশরুম পাওয়া যাবে ।

মাশরুম সংগ্রহ ও সংরক্ষণ : মাশরুম যথেষ্ট বড় হয়েছে কিন্তু শিরাগুলাে ঢিলা হয়নি এমন অবস্থায় হাত দিয়ে আলতাে করে টেনে তুলতে হবে । পরে গােড়া কেটে বাছাই করে পলি ব্যাগে ভরে মুখ বন্ধ করে বাজারজাত করতে হবে । এগুলো ঠাণ্ডা জায়গায় ২ - ৩ দিন রেখে খাওয়া যায় । ফ্রিজে রাখলে ৭ - ৮ দিন ভালাে থাকে ।

মাশরুম চাষের প্রয়ােজনীয়তা

আমরা জানি ছত্রাক ফসলের অনেক রােগের জন্য দায়ী । কিন্তু সব ছত্রাক রােগ সৃষ্টি করে না । অনেক ছত্রাক রয়েছে যারা আমাদের জন্য উপকারী । মাশরুম এমন এক ধরনের ছত্রাক যা সম্পূর্ণ খাওয়ার উপযােগী , পুষ্টিকর , সুস্বাদু ও ঔষধি গুণ সম্পন্ন । আসলে মাশরুম এক ধরনের মৃতজীবী ছত্রাকের ফলন্ত অঙ্গ যা ভক্ষণযােগ্য ।
অনেকে ভুল করে মাশরুম ও ব্যাঙের ছাতাকে এক জিনিস মনে করে । ব্যাঙের ছাতা প্রাকৃতিকভাবে যত্রতত্র গজিয়ে উঠা বিষাক্ত ছত্রাকের ফলন্ত অঙ্গ । আর মাশরুম টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উৎপন্ন বীজ দ্বারা পরিচ্ছন্ন পরিবেশে চাষ করা সবজি । মাশরুম নিজে সুস্বাদু খাবার এবং অন্য খাবারের সাথে ব্যবহার করলে তার স্বাদও বাড়িয়ে দেয় । মাশরুমের স্বাদ মাংসের মতাে । মাশরুম দিয়ে চায়নিজ ও পাঁচতারা হােটেলে নানা রকম মুখরােচক খাবার তৈরি করা হয় । তবে দেশীয় পদ্ধতিতে মাশরুম সবজি , ফ্রাই , স্যুপ , পােলাও , বিরিয়ানি , নুডুলস , চিংড়ি ও ছােট মাছের সাথে ব্যবহার করা যায় । মাশরুম তাজা , শুকনা বা গুঁড়া হিসেবে খাওয়া যায় ।

পুষ্টিমান বিচারে মাশরুম সবার সেরা ফসল । কারণ মাশরুমে অতি প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান , যেমন প্রােটিন , ভিটামিন ও মিনারেলস অতি উচ্চ মাত্রায় আছে । প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনা মাশরুমে ২৫ - ৩৫ গ্রাম আমিষ , ১০ - ১৫ গ্রাম সব ধরনের ভিটামিন ও মিনারেলস , ৪০ - ৫০ গ্রাম শর্করা ও আঁশ এবং ৪ . ৬ গ্রাম চর্বি আছে । মাশরুমের আমিষ অত্যন্ত উন্নত মানের । এ আমিষে মানবদেহের জন্য প্রয়ােজনীয় ৯টি এমাইনাে এসিডই আছে । এ আমিষ গ্রহণে উচ্চ রক্তচাপ , হৃদরােগ ও মেদভুড়ি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না । কারণ আমিষের সাথে ক্ষতিকর চর্বি থাকে না । পক্ষান্তরে মাশরুমের চর্বি হাড় ও দাঁত তৈরিতে এবং ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়তা করে । মাশরুমের শর্করায় অনেক ধরনের রাসায়নিক উপাদান থাকে যা অনেক জটিল রােগ নিরাময়ে কাজ করে । ভিটামিন ও মিনারেল দেহের রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা তৈরি করে । আমাদের দেহের জন্য দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ ভিটামিন ও মিনারেলের চাহিদা রয়েছে । আমরা প্রতিদিন মাশরুম খাওয়ার মাধ্যমে প্রয়ােজনীয় ভিটামিন ও মিনারেলের চাহিদা মেটাতে পারি । মাশরুমে থায়ামিন ( বি ১ ) , রিবােফ্লাবিন ( বি ২ ) , নায়াসিন ইত্যাদি ভিটামিন এবং ফসফরাস , লৌহ , ক্যালসিয়াম , কপার ইত্যাদি মিনারেল প্রচুর পরিমাণে রয়েছে । পুষ্টিগুণের কারণে মাশরুম অনেক রােগের প্রতিরােধক ও নিরাময়কারী হিসেবে কাজ করে , যেমন - ডায়াবেটিস , হৃদরােগ , উচ্চ রক্তচাপ , রক্তশূন্যতা , আমাশয় , চুল পড়া , ক্যান্সার , টিউমার ইত্যাদি ।

একজন সুস্থ লােকের প্রতিদিন ২০০ - ২৫০ গ্রাম সবজি খাওয়া প্রয়ােজন । আমরা প্রতিদিন গড়ে ৪০ - ৫০ গ্রাম ( আলু বাদে ) সবজি খাই । যা চাহিদার তুলনায় খুবই কম । ফলে শরীরের জন্য প্রয়ােজনীয় ভিটামিন ও মিনারেলের অভাবে বিভিন্ন রােগে ভুগে থাকি । বাংলাদেশে দ্রুত চাষযােগ্য জমি কমে যাচ্ছে । অধিকাংশ জমি ধান চাষে ব্যবহৃত হয় । সবজি চাষের আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ানাে কঠিন । এমতাবস্থায় মাশরুম হতে পারে আদর্শ ফসল । মাশরুম এমন একটি ফসল যা চাষ করার জন্য কোনাে উর্বর জমির প্রয়ােজন নেই । ঘরের মধ্যে তাকের উপর রেখেও চাষ করা যায় এবং অত্যন্ত অল্প সময়ে অর্থাৎ ৭ - ১০ দিনের মধ্যে ফলানাে যায় । বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু মাশরুম চাষের অত্যন্ত উপযােগী । মাশরুম চাষের উপকরণ , যেমন - খড় , কাঠের গুড়া , আখের ছােবড়া , পচা পাতা ইত্যাদি সস্তা ও সহজলভ্য ।

মাশরুম চাষ ব্যবসায়িক দিক থেকে খুবই লাভজনক । কারণ মাশরুম চাষে কম পুঁজি , কম শ্রম দরকার হয় । অল্প দিনের মধ্যে বিনিয়ােগকৃত অর্থ তুলে আনা যায় । অন্যদিকে একক জায়গায় অধিক ফলন , লাভজনক বাজারমূল্য পাওয়া যায় । তাই মাশরুম চাষ করে বেকার যুবসমাজ সহজেই আত্ম - কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে । ঘরে ঘরে মাশরুম চাষ করে পরিবারের পুষ্টির চাহিদা যেমন মেটানাে যাবে তেমনি বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে ।

Post a Comment

0 Comments